১৯ আগস্টের এক সেমিনারে বক্তাদের বক্তব্যে উৎকণ্ঠিত মানুষ। সম্প্রতি জানা যায় দেশে ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করেন একজন মাত্র কীটতত্ত্ববিদ। সেমিনারে জানা গেলো দেশে অনেক কীটতত্ত্ববিদ রয়েছেন,যারা ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু ভয়াবহ এডিস নিয়ন্ত্রণের কাজে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এক সিটি করপোরেশনে কীটতত্ত্ববিদের কাজ করেন চিকিৎসক। সেখানে কীটতত্ত্ববিদদের উপেক্ষা করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হয়।
মশার ডিম ও পূর্ণাঙ্গ মশা মাছ,পাখি ও অন্যান্য উপকারী পতঙ্গের খাবার। তাই মশাকে বিলুপ্ত করলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হতে পারে। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না এই নীতিতে এডিস দূর করে দেশ থেকে ডেঙ্গু নির্মূল করার পরামর্শ আসে সেমিনার থেকে। তবে ডেঙ্গুর বিষয়ে গবেষণার বিষয়টি প্রাধান্য পায় না কোন ভাবেই। আবার দেশে কোনো কোনো বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিল্যাবে ডেঙ্গু নিয়ে তাড়াহুড়ো করে গবেষণার নামে নানা অর্ধসত্য ও অসত্য তথ্য পরিবেশন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার খবরও রয়েছে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা এডিস নিয়ন্ত্রণে নর্দমার মধ্যে হাঁস,ব্যাঙ,তেলাপিয়া, টাকিমাছ, ফড়িং ছেড়ে দিয়ে অর্থের অপচয় করেন। এসব উদ্যোগকে জনগণের টাকায় শুধু তামাশা হিসেবে উল্লেখ করেন প্রখ্যাত বিজ্ঞান বক্তারা। মানুষ যখন ডেঙ্গু ভয়ে ভীত তখন তাদের বাড়িতে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে জরিমানা করা হয়। আবার মশক নিয়ন্ত্রণে বিদেশ থেকে পরিক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই অকার্যকর ওষুধ আমদানি করা হয় জনগনের পরিশ্রমের অর্থে।
এ পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৫০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন চিকিৎসকও রয়েছেন। একই সময়ে এক লাখ ছয় হাজার ৪২৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হন এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পান ৯৮ হাজার ৯৮ জন। নিজের দোষ স্বীকার করতে অনভ্যস্ত জাতি আমরা। তাই এত ভয়াবহতার মাঝেও ডেঙ্গুকে মহামারি হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি নেই। তবে কোনো সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় প্রথম ধাপ হলো সেই সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। এখন বলা হচ্ছে,আত্মরক্ষার দায়িত্ব সবার। তাই যদি হয় তাহলে এতদিন পর একথা বলা কি প্রবঞ্চনা ও সামাজিক অপরাধ নয়? এদেশের সর্বভুক মানুষগুলো গোগ্রাসে খাওয়া থামাতে পারছে না। একশ্রেণির ধনী, লুটেরা, অসৎ ব্যবসায়ী,রাজনীতিবিদ,আমলা ক্ষমতাধর মানুষ দেশের সম্পদ গোগ্রাসে গিলছে। সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট জানতে চেয়েছেন “একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কত অর্থ প্রয়োজন? ” প্রশ্নটা আমজনতার, কিন্তু উত্তর দেবে কে?
সোফোক্লিস। প্রাচীন গ্রিক বিয়োগান্তক নাটক রচয়িতাদের একজন। তিনি বলেছেন,“প্রতারণা করে সফল হওয়ার চেয়ে সম্মানের সাথে ব্যর্থ হওয়া ভাল।” প্রতিদিন চুরি-চামারি, জালিয়াতি ও আত্মসাতের খবর পড়ে অনেকেই ভাবেন, যারা সৎপথে দুটো টাকা আয় করে সম্মানের সাথে বাঁচার আশায় সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রম করে,মাস গেলে যে টাকা হাতে আসে এর একটি টাকাও ব্যাংকে জমা রাখার সুযোগ পায় না, তারা কী বোকা? সততা কি তাদের দুর্বল করে রেখেছে? অথচ তাদের অনেকের চাইতেও অথর্ব, কম জ্ঞান ও কমযোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ কোটি কোটি টাকার উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে পা দুলাচ্ছে। একধরনের হতাশা থেকেই তাদের মধ্যে এই ক্লেদ জমা হচ্ছে। কেউ আয় করবে, অর্জন করবে, আরাম-আয়েশে জীবন কাটাবে, আকাশে উড়বে, চাঁদে বেড়াতে যাবে, জয়মাল্য পরবে, এতো আনন্দের কথা, অর্জনের কথা। এসব দেখে সাধারণের হিংসা বা কষ্ট হয় না,কষ্টটা অন্য জায়গায়। বন উজাড়, পাহাড় কাটা, নদী দখলের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্যের জমি, সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ।
যখন সংবাদপত্রে খবর আসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। যখন শোনা যায় ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। যখন জানা যায় দুবাইতে বাংলাদেশীরাই সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী, তাদের বিনিয়োগের জোরে সে দেশের অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠছে। জনগণের টাকা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে সেই তস্কররা,তখনই কষ্ট হয়। ব্যাংকের কোষাগার খালি হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নাকি টাকা ছাপাচ্ছে অভাব মেটানোর জন্য,অথচ এই অবস্থায়ও “বিশেষ বিবেচনায়” বেক্সিমকো গ্রুপকে ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় জনতা ব্যাংক। কিন্তু কেন নিয়ম না থাকার পরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই অনুমতি ?
টাকা ছাপিয়েই কি সব সমস্যার সমাধান করা যায়? ঋণ করে ঘি খাওয়ার কাজ কতটা অর্থপূর্ণ? অনেকে বলেন, ১১ মাসে ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাপানোই মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক মূদ্রার মূল্য বৃদ্ধির মূল কারন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য গত ১১ মাসে সরকার যে টাকা ছপিয়েছে সেটা খবর হয়েছে মিডিয়ায়। উন্নয়নের কাজে এই ছাপানো টাকা কতটা লাগবে? তবে এই টাকার লভ্যাংশ পেয়েছে ব্যবসায়ীরা, সুযোগ সুবিধা পেয়েছে বিশেষ শ্রেণির কর্মকর্তারা। এই ৭০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়েছে ডলারের দাম। এখন সেই দায়ে খাবি খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
বাবা মায়ের সাথে নতুন শহরে যাবে ছোট্ট মেয়ে চিহিরো। যেতে যেতে পথ হারিয়ে একটি বনের ভেতরে ঢুকে পড়ে তারা। সেই বনের ভেতরে এগুতেই হঠাৎ সামনে দেখামেলে একটি প্রাচীন বাড়ির দরজা এবং এক আজব মূর্তি। চিহিরো এই রকম পরিবেশ দেখে ভয় পায়,ফিরে যেতে চায়। বাবা মা তাকে গাড়িতে থাকতে বলে। ছোট্ট চিহিরোকে তারা বলে বাড়িটির ভেতরটা দেখেই চলে আসবে। কিন্তু একা একা ভয় পেয়ে চিহিরো তাদের পিছু নেয়। চিহিরোর বাবা-মা বাড়িটির ভেতরে গিয়ে দেখে বাড়ির পেছনে বাইরে বেরুবার একটি রাস্তা দেখা যাচ্ছে। সেটি দিয়ে তারা এগিয়ে দেখে সেখানে জনমানবহীন অন্য এক শহর। শহরটিতে ঢোকামাত্র খাবারের মন মাতানো গন্ধ পেতে থাকে তারা। একটু এগিয়েই দেখে টেবিলে সারি সারি খাবার সাজিয়ে রাখা। চারপাশে কেউ নেই। অনেক ডাকাডাকি করে কাউকে না পেয়ে চিহিরোর মা-বাবা ভাবে এবার খেয়ে নেয়া যাক,কাউন্টারে লোক এলে বিল দেয়া যাবে। এই ভেবে তারা বাহারী সুস্বাদু খাবারগুলো খেতে শুরু করে। ওদিকে চুপচাপ ভূতুড়ে পরিবেশ দেখে চিহিরোর ভয় আরো বেড়ে যায়। বাবা মাকে ছেড়ে আজব ভীতিকর এলাকা ঘুরে ফিরে দেখতে থাকে চিহিরো। এদিকে সুস্বাদু সব খাবার গোগ্রাসে খেতে থাকে চিহিরোর বাবা-মা। চিহিরো ঘুরে এসে পেছন থেকে দেখে মা বাবা বেশ মোটা হয়ে গেছে খেতে খেতে। ভয় পেয়ে তাদের ডাক দিলে তারা ফিরে তাকায়। চিহিরো অবাক হয়ে দেখে তার বাবা-মা মানুষ নেই,শুকরে পরিণত হয়েছে তারা। সে দেশের যে ডাইনি সে এইভাবে লোভী মানুষদের ধরে এনে খাইয়ে খাইয়ে মোটা তাজা করে এবং একদিন রোষ্ট বানিয়ে তাদের খেয়ে ফেলে। জাপানের স্টুডিও জিবলির এনিমেটেড ফিল্ম ‘স্পিরিটেড অ্যওয়ে’ এর গল্পের একটি অংশ এটি।
আমাদের অনেকেই চিহিরোর বাবা-মায়ের মত শুধু গোগ্রাসে খাচ্ছেন। অন্যের জমি, টাকা, সম্পদ, বাড়িঘর। পার্ক, পাহাড়, সমুদ্র, বনভূমি, নদী, মাটি, শহর, গ্রাম,উপকূল ভূমিও বাদ যাচ্ছেনা। এরা মানুষ,পশুপাখিও খেয়ে ফেলতে পারে। ডিজিটাল প্রতারণা করে যেমনটি খেয়ে ফেলেছে অসংখ্য সাধারণ মানুষের সর্বস্ব। এমটিএফই নামের এই প্রতিষ্ঠান প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে ‘কোটি কোটি’ টাকা। যে অ্যাপে তারা বিনিয়োগ করেছিলেন, সেই অ্যাপ আর কাজ করছে না। মুঠোফোনের অ্যাপে নিবন্ধন, ডলার কিনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার হাতছানি, এক কান, দুই কান থেকে শত শত মানুষের কানে এই লোভের বার্তা ছড়িয়ে যায়। মানুষের সঙ্গে এই প্রতারণা করেছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপ ইনকরপোরেটেড নামের প্রতিষ্ঠান, যা সংক্ষেপে ‘এমটিএফই’ নামে পরিচিত। মানুষ পরিশ্রম না করে সহজে টাকা আয়ের স্বপ্নে বিভোর থাকে, একবারও ভেবে দেখে না, এত সহজে লাখ লাখ টাকা আয় করা কি আদৌ সম্ভব ? একটি অসাধু প্রতিষ্ঠান কিভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে এরকম প্রতারণা চালিয়ে নিতে পারে? কেউ তাদের প্রশ্ন করেনি, জবাবদিহিতাও নেই, বাধাও দেয়নি কেউ। এর আগে ডেসটিনিসহ বিভিন্ন প্রতারক প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ব্যবসা করে মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমান টাকা হাতিয়ে নেয়। ই-কমার্স নাম দিয়ে অনেকে সব নিয়ন্ত্রক সংস্থার সামনেই হাজার কোটি টাকা পকেটস্থ করে।
বড় অংকের ঋণ জালিয়াতি আর খেলাপির দায়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে কিভাবে বিপাকে পড়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেয়া হয় ঠিকই, কিন্তু সেই টাকা আর ফেরত আসে না। সেই টাকাও খেয়ে ফেলে অসাধুচক্র। ফলে ওইসব ঋণ খেলাপি হয়েই থেকে যায়। ঋণ খেলাপি হলেই ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। ব্যাংকের টাকা খেয়ে ফেলার আরেকটি উপায় হচ্ছে ’ঋণ অবলোপন’। ব্যাংক বিশ্লেষকদের ভাষায় যা ঋণ জালিয়াতির চেয়েও ভয়াবহ। যে ঋণ একেবারে আদায় করা সম্ভব হয় না, তা অবলোপন করা হয়, অর্থাৎ মোট ঋণের পরিসংখ্যান খাতা-কলমে কম দেখানো হয়। প্রভাবশালীরা এর সুযোগ নিয়ে ঋণের টাকা খেয়েফেলেন। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকের উচ্চপদস্থরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে সমঝোতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে বড় অংকের ঋণ নিয়ে থাকেন। যার বেশিরভাগই পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়,পরে যা অবলোপন করা হয়।
একই দেশ একই সমস্যা অথচ মানুষের জীবনবোধ ও চাহিদার কত ফারাক, কত বৈপরীত্য। যারা খাচ্ছেন,তারা মানুষের নিঃশ্বাস নেয়ার মতো মুক্ত জায়গা, হাঁটার পার্ক,গাছের ছায়া,নদী-নালা, খাল-বিল, বনভূমি সব হজম করার পরিকল্পনা করে। কক্সবাজারের বনাঞ্চলের ভেতর উন্মুক্ত কারাগার বানাতে চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অধীনে থাকা কারা অধিদপ্তর। চারিদিকে এত জায়গা থাকতেও একটি সুরক্ষিত বনের ভেতরে কারাগার স্থাপন করতে হবে কেন ?
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শীর্ষ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। অথচ বন উজাড়, নদী ভরাট,পাহাড় কাটা,বনভূমি দখল করে সাফারি পার্ক বানানোতে কেউ থেমে নেই। এর আগে সংরক্ষিত শালবন উজাড় করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বানাতে চেয়েছে বিসিক। আশংকার কথা হচ্ছে যেহেতু বাংলাদেশ বন উজাড় বন্ধ সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি,কাজেই যেকোন ছুতায় এই বন উজাড় হয়ে যেতেই পারে। বন উজাড়, পাহাড় কাটা ও নদী দখলের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্যের জমি,সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ। সর্বভুক মানুষগুলোর গোগ্রাসে খাওয়া থামাতে পারছে না। একশ্রেণির ধনী, লুটেরা, অসৎ ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, ক্ষমতাধর দেশের সম্পদ গোগ্রাসে গিলছে তো গিলছেই।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply